মুরগির পোল্ট্রি খামার শুরু করার বিবেচ্য বিষয় সমূহ ( পর্ব-৩)

মুরগির পোল্ট্রি খামার শুরু করার বিবেচ্য বিষয় সমূহ পর্ব-১(ক্লিক করুন) ও পর্ব-২(ক্লিক করুন) হতে কারো আরো বিস্তারিত জানার থাকলে সরাসরি আমাকে কল করতে পারেন| আমি সর্বদায় সকল খামারি উদ্যেক্তা দের ২৪ ঘন্টায় সেবা দান করতে প্রস্তুত আছি| মুরগির পোল্ট্রি খামার শুরু করার বিবেচ্য বিষয় সমূহ ( পর্ব-৩)
পোল্ট্রি খামার পর্ব -৩

পোষ্টে আজ আমি,  ব্রুডিং কাকে বলে, ব্রুডিং এর উদ্দেশ্য কি , ব্রুডিং ঘরের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ব্রুডিং পিরিয়ড ব্যবস্থাপনা, গ্রোয়িং পিরিয়ড ব্যবস্থাপনা, প্রি-লেয়িং পিরিয়ড ব্যবস্থাপনা, লেয়িং পিরিয়ড ব্যবস্থাপনা এবং পোল্ট্রি খামারের আলোকদান কর্মসূচী নিয়ে আলোচনা করব|

ব্রুডিং কাকে বলে?

জীবনের প্রারম্ভিক পর্যায়ে বাচ্চা মুরগি যখন তার শরীরের তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারে না, তখন কৃত্রিম ভাবে তাপায়িত পরিবেশ সৃষ্টি করে মুরগির বাচ্চা লালন-পালন করা কে ব্রুডিং বলে|
মুরগির ব্রুডিং

ব্রুডিং এর উদ্দেশ্যঃ

১) মুরগির বাচ্চার রোগ-প্রতিরোধ শক্তি গড়ে উঠে
২) সকল টিকা বা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়
৩) সকল বাচ্চার দৈহিক গঠন সঠিক ভাবে হয়
৪) আবহাওয়ার প্রতিকূলতার থেকে বাচ্চা-কে রক্ষা করা যায়
৫) সঠিক সময়ে বাচ্চাকে সঠিক তাপমাত্রা দেওয়া যায়
৬) বিভিন্ন প্রকার রোগ থেকে বাচ্চাকে রক্ষা করা যায়
৭) বাচ্চার মৃত্যুর হার কম হয়
৮) মুরগির উদপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়
ব্রুডিং সময়ঃ গ্রীষ্মকাল ৩-৪ সপ্তাহ
শীতকাল ৫-৬ সপ্তাহ

ব্রুডিং ঘরের প্রয়োজনীয় উপদানঃ

১) জায়গার পরিমান ২) তাপমাত্রা ৩) আদ্রতা ৪) বায়ু প্রবাহ ৫) আলো

ব্রুডিং ঘরের প্রয়োজনীয় উপকরন বা যন্ত্রপাতীঃ

০১) খাদ্য পাত্র (  লম্বা খাদ্য পাত্র ,  গোলাকার খাদ্য পাত্র )
০২) পানির পাত্র( ছোট গোলাকার পানির পাত্র, বড় গোলাকার পানির পাত্র)
০৩) লিটার ( মুরগির বিছানাকে লিটার বলে , ধানের তুষ, কুড়া, কাঠের গুড়া, বালু, খড় ইত্যাদি ব্যবহৃত হয় )
০৪) ব্রুডার (মুরগির বাচ্চার ঘরে তাপের উৎসকে ব্রুডার বলে। ব্রুডার হিসেবে বৈদ্যুতিক হিটার, কেরোসিন বাতি, হ্যাজাক, ইত্যাদি ব্যবহার করে কৃত্রিম উপায়ে তাপ দেয়া যায়। সাধারণত গ্রীষ্মকালে ১০০ ওয়াটের ২টি বাল্ব এবং ৬০ ওয়াটের ১টি বাল্ব আর শীতকালে ২০০ ওয়াটের ২টি এবং ১০০ ওয়াটের ২টি বাল্ব প্রতি ৫০০ বাচ্চার জন্য ব্রুডারে ব্যবহার করা যথেষ্ট। বাচ্চা ব্রুডারে ছাড়ার ১০-১২ ঘন্টা পূর্বে ব্রুডার চালু করে প্রয়োজনীয় তাপ দিতে হবে।)
০৫) চিকগার্ড ( ব্রুডার থেকে ১.৫-৩ ফুট দুরত্বে ১.৫ ফুট উচুঁ চাটাই বা হার্ডবোর্ডের বা তারের জালের বেষ্টনী তৈরি করা হয়। ফলে বাচ্চা ব্রুডার থেকে দূরে যেতে পারে না। প্রতি ৫০০ বাচ্চার জন্য চিকগার্ডের ব্যাস হবে ১২ ফুট (ব্যাসার্ধ ৬ ফুট। ক্ষেত্রফল = ৩.১৪ x ৩৬ = ১১৩.০৪ বর্গফুট)। প্রতিটি বাচ্চার জন্য জায়গা হবে ১১৩.০৪/৫০০ = ০.২১৮ বর্গফুট। চিকগার্ডের উচ্চতা গরমের সময় ১'-৬'' এবং শীতের সময় ২'-৬'' হবে। বাচ্চা বড় হবার সাথে সাথে চিকগার্ডের পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে।।)
০৬) হুভার ( তাপ যাতে উপরের দিকে উঠে না যায় সেজন্য হোভার প্রয়োজন। হোভার টিন, কাঠ বা বাঁকা বাঁশ দ্বারা তৈরী করা যায়। হোভারকে সাধারণতঃ ঝুলিয়ে রাখা হয়। তবে নীচে পা লাগিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা যায়। ৫ ফুট ব্যাস হোভারের নীচে ৫০০টি বাচ্চা রাখা যায়।)
০৭) ব্রুডিং এর জন্য প্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি
০৮) আদ্রতা পরিমাপের জন্য হাইগ্রোমিটার ও তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য থার্মোমিটার
০৯) পর্দা ( পলিথিন চট, কাপড়)
১০) বেলচা, বালতি, মগ
১১) ভ্যাকসিনের জন্য থার্মোফ্লাক্স
১২) দড়ি বা রশি
১৩ ) হারিকেন বা চার্জার বা আইপি এস
১৪) ওজন মাপার যন্ত্র
১৫) পেপার বা কাগজ
১৬) কাঠ বা ইটের টুকরা
১৭) গামবুট
১৮) ঝাড়ু
১৯) সিরিজ ড্রপার
২০) স্প্রে মেশিন ইত্যাদি

পোল্ট্রি খামারে মুরগি বা যে কোন পাখি পালনের জন্য চার ভাগে এর পালন সময় কে ভাগ করা হয়| যেমনঃ

ক- ব্রুডিং পিরিয়ড  (০-৬ সপ্তাহ)
খ-গ্রোয়িং পিরিয়ড  (৭-১৪ সপ্তাহ)
গ- প্রি-লেয়িং পিরিয়ড  (১৫-১৮ সপ্তাহ)
ঘ- লেয়িং পিরিয়ড  (১৯ - শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত )


(ক) ব্রুডিং পিরিয়ড ব্যবস্থাপনা (০-৬ সপ্তাহ):

০১) বিশুদ্ধ পানির সাথে ৫-১০% গ্লুকোজের দ্রবণ তৈরি করে বাচ্চা আসার ৩-৪ ঘন্টা পর্যন্ত এই পানি খাওয়াতে হবে|
০২) চিকবক্স হতে বাচ্চা গুলো বের করার পরপর বাচ্চা গুলোর ঠোঁট পানিতে নিমিজ্জিত করতে সহয়তা করতে হবে|
০৩) ১ম সপ্তাহে পানির সাথে ইলেক্ট্রোলাইট যুক্ত পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন খাওয়াতে হবে|
০৪) লিটার বস্তু কর্দমাক্ত রোধ করার জন্য পানির পাত্র ও খাদ্য পাত্রের নিচে কাঠ বা ইটের টুকরো রাখতে হবে|
০৫) বাচ্চা গুলোকে তাপের কাছে রাখার জন্য সঠিক মাপের চিকগার্ড ও আকর্ষনীয় আলোকসজ্জা ব্যবহার করতে হবে|
০৬) ব্রুডিং পিরিয়ডে বাচ্চা গুলোকে নিম্ম লিখিত হারে তাপমাত্রা দিতে হবে|
০৭) বাচ্চা আসার ২-৩ ঘন্টা পর হতে পেপারের উপর খাদ্য ছড়িয়ে দিতে হবে|
০৮) ১ম দুই সপ্তাহ বাচ্চা গুলোকে পর্যাপ্ত পরিমান খাদ্য খাওয়াতে হবে এবং পুরুষ ও স্ত্রী বাচ্চা গুলো একসাথে পালন করা হয়|
০৯) ৩য় সপ্তাহ বয়সে মুরগি গুলোর দৈহিক ওজন পর্যবেক্ষন করতে হবে এবং নির্দেশিকা অনুযায়ী খাদ্য তালিকা ঠিক করতে হবে|
১০) পূর্ব নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী সকল প্রকার ভ্যাকসিন বা টিকা প্রদান করতে হবে|
১১) ১০-১২ দিন বয়সে প্রথমবার বাচ্চা গুলোর ঠোঁট কাটতে হবে|

(খ) গ্রোয়িং পিরিয়ড ব্যবস্থাপনা (৭-১৪ সপ্তাহ):

০১) ৬ সপ্তাহ বয়সের পর বাচ্চা গুলির লক্ষ মাত্রা দৈহিক ওজন প্রাপ্ত হলে ৬ সপ্তাহ পর হতে বাচ্চা গুলোকে গ্রোয়ার ডাইট খাদ্য সরবারহ করতে হবে|
০২) দৈহিক ওজন, খাদ্য গ্রহন হার, তাপমাত্রা, আলোকদান কাল, স্বাস্থ্যরক্ষা কার্মসূচী এবং মৃত্যুহারের রেকর্ড রাখতে হবে|
০৩) ১০-১২ সপ্তাহ বয়সে অথবা পূর্নতা প্রাপ্তির পূর্বে মুরগিগুলোর ঠোঁট ২য় বারের মত কেটে দিতে হবে|
০৪) মুরগি গুলোকে লেয়ার ঘরে স্থানান্তরের পূর্বে নির্ধারিত সকল প্রকার ভ্যাকসিন দেওয়া শেষ করতে হবে|

(গ) প্রি-লেয়িং পিরিয়ড ব্যবস্থাপনা (১৫-১৮ সপ্তাহ):

০১) সাধারনত মুরগি গুলোর ১৮ সপ্তাহ বয়সের মধ্যে লেয়ার ঘরে স্থানান্তর করতে হবে| তবে ১৮ সপ্তাহ বয়সে স্থানান্তর করা ঠিক হবে না|
০২) ঘর ভালো ভাবে পরিষ্কার ব্যাতিত ঘরের ভেতর পুলেট প্রবেশ করানো যাবে না| অথবা বয়স্ক মুরগির সাথে একই ঘরে পুলেট দেওয়া যাবে না| [ ১ বছরের নিচে স্ত্রী জাতীয় মুরগীকে পুলেট বলে ]
০৩) আলোকদান কর্মসূচী অবশ্যই ধারাবাহিক হতে হবে| পুলেট ঘরে প্রবেশ করানোর আগের দিন হতে কখন লাইট জ্বলবে বা বন্ধ হবে জানতে হবে

(ঘ) লেয়িং পিরিয়ড ব্যবস্থাপনা (১৯- শেষ সপ্তাহ):

০১) যথাযথ মুরগির ঘনত্ব, খাবার পাত্র, পানির পাত্রের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা প্রজনন কারীর নির্দেশিকা অনুযায়ী দিতে হবে|
০২) লেয়িং পিরিয়ডের মুরগি গুলোকে লেয়ার খাদ্য সরবারহ করতে হবে|
০৩) ১০০ টি স্ত্রী জাতীয় মুরগির জন্য ৮-১০ টি মুরগ রাখতে হবে| (হ্যাচিং এর জন্য)
০৪) ডিমের বাক্স হতে ডিম সংগ্রহ করার পূর্বে হাত ভাল ভাবে ধুয়ে নিতে হবে|
০৫) হ্যাচিং এর জন্য মেঝেতে পড়া ডিম ব্যবহার করা যাবে না|
০৬) সংগ্রহের পর ডিম গুলোকে দ্রুত ফিউমিগ্যাশন করতে হবে|
০৭) জৈব নিরাপত্তা নীতি সমূহ যথাযথ অনুসরন করতে হবে|

মুরগির আলোকদান কর্মসূচীঃ

*আলো নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন কি?

মুরগীর যৌন পরিপক্কতা, হরমোন ক্ষরণ ও খাবার গ্রহণের জন্য।
*বছরের সব ঋতুতে একই মাত্রায় কি আলোর দরকার হয়?
• দিনের দৈর্ঘের উপর নির্ভরশীল, শীতের মৌসুমে আলোর দীর্ঘতা বাড়াতে হয়।

*বয়সভেদে কতক্ষণ আলো রাখা দরকার?

•১৯-২০ সপ্তাহে ১২ ঘন্টা, প্রতি সপ্তাহে আধা ঘন্টা হিসাবে বাড়িয়ে ২৮-৭২ সপ্তাহে প্রতিদিন ১৬ ঘন্টা আলো রাখা দরকার।

*কি কি উদ্দেশ্যে আলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়?

• ঠিক বয়সে ঠিক ওজনে ঠিক আকারের অধিক ডিম উৎপাদনের উদ্দেশ্যে আলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

*কি ধরনের বাল্ব দিতে হবে?

•একটি ৬০ ওয়াটের বাল্ব ১২০ বর্গফুট জায়গার আলো দেয়ার জন্য, এক বাল্ব থেকে আরেক বাল্ব পর্যন্ত ১০ ফুট দূরত্বে ৭-৮ ফুট উঁচুতে রাখতে হবে। টিউব বাল্ব ব্যবহার করা ভালো। হ্যাচারীর নির্দেশ পালন করা উত্তম।

*বয়সভেদে আলোর প্রখরতা কি রকম হতে পারে?

•ব্রুডিং অবস্থায় ২০-৩০ লাক্স, বাড়ন্ত অবস্থায় ১০-২০ লাক্স এবং ডিমপাড়া অবস্থায় ২০-৩০ লাক্স।

*লাক্স হিসাবে কত ওয়াটের, কয়টি বাল্ব, কতটুকু জায়গায় আলো দিতে পারবে?

•১০ লাক্স-১ ওয়াট ১বর্গফুট, ২০ লাক্স-১ওয়াট ২ বর্গফুট, ডিমপাড়ার সময় ১ ওয়াট ১.৫ বর্গফুট জায়গায় আলো দেবে।
নিচের চার্টে বয়স অনুযায়ী মুগির ঘরে কতক্ষন আলো থাকবে তার বর্ননা
মুরগির আলোক দান কর্মসূচী

মন্তব্যসমূহ